"দ্য বেঙ্গল ফাইলস" ট্রেলার আটকালো কলকাতা পুলিশ — ইতিহাস লুকানো হচ্ছে, নাকি রাজনীতির খেলা?

কলকাতা, ১৬ আগস্ট ২০২৫: শহরের একটি পাঁচতারা হোটেলে শুধু একটি ট্রেলার দেখানো হয়নি — তার চেয়েও বড় কিছু থামিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেটা হল গণতন্ত্রের আওয়াজ, ইতিহাসের সত্য, এবং মুক্ত অভিব্যক্তির অধিকার। বিবেক অগ্নিহোত্রী পরিচালিত নতুন চলচ্চিত্র "দ্য বেঙ্গল ফাইলস"-এর ট্রেলার প্রদর্শন থামিয়ে দেয় কলকাতা পুলিশ। আর তারপর থেকেই শুরু হয়েছে রাজনৈতিক ঝড়, মিডিয়া তোলাবালা, এবং জনমনে প্রশ্ন — "কেন?"

 

 

ঘটনার বিবরণ: হঠাৎ পুলিশের হানা

শনিবার দুপুরে কলকাতার একটি বিলাসবহুল হোটেলে "দ্য বেঙ্গল ফাইলস"-এর ট্রেলার প্রদর্শন ও প্রেস কনফারেন্সের আয়োজন ছিল। পরিচালক বিবেক অগ্নিহোত্রী এবং প্রযোজক অভিষেক আগরওয়াল উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু প্রায় ১টা ১৫ মিনিট নাগাদ হোটেলের এক কর্মকর্তা ঘোষণা করেন যে, শুধু প্রেস কনফারেন্সের অনুমতি ছিল, ট্রেলার দেখানোর নয়।

 

অগ্নিহোত্রী প্রশ্ন তোলেন — "যদি ট্রেলার দেখানো যাবে না, তবে ফিল্মের প্রেস মিট কীভাবে হয়?"

 

এরপর কিছুক্ষণ বাদে ট্রেলার আবার শুরু হয়। কিন্তু তখনই ঘটনার নাটকীয় মোড়। হঠাৎ করে ৫-৬ জন কলকাতা পুলিশের আধিকারিক ব্যানকোয়েট হলে প্রবেশ করে ট্রেলার দেখানো বন্ধ করে দেন।

 

অগ্নিহোত্রী পুলিশ এবং হোটেল কর্মীদের সাথে তীব্র বাকবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন। তিনি দাবি করেন, এটি ছিল "উচ্চপদস্থ কারও নির্দেশে গণতান্ত্রিক অধিকারের উপর হামলা"

 

 

অগ্নিহোত্রীর অভিযোগ: "কে ভয় পাচ্ছে সত্যের?"

এক সাংবাদিক সম্মেলনে অগ্নিহোত্রী বলেন,

"সেন্সর বোর্ড ফিল্মটি পাশ করেছে। কলকাতা হাইকোর্ট এর উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা স্থগিত করেছে। তবু কেন ট্রেলার দেখানো যাচ্ছে না? কে ভয় পাচ্ছে বাঙালি হিন্দুদের উপর ১৯৪৬ সালের গণহত্যার সত্য প্রকাশিত হওয়ার?"

 

তিনি সরাসরি অভিযোগ করেন যে, তৃণমূল কংগ্রেসের চাপেই হোটেল এবং পুলিশ এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে কে সেই "উচ্চপদস্থ কেউ"? তিনি বলেন,

"আমি শুধু বলেছি — কেউ একজন উপরে।"

 

একটি এক্স (পূর্বের টুইটার) পোস্টে তিনি লেখেন:

"বেদনা নিয়ে জানাচ্ছি: আজ পশ্চিমবঙ্গ পুলিশ, 'উচ্চ কর্তৃপক্ষের' নির্দেশে, আইন ছাড়াই #TheBengalFiles-এর ট্রেলার আটকে দিয়েছে। আগে সিনেমাহল, এখন বেসরকারি হোটেল। কে ভয় পাচ্ছে হিন্দু গণহত্যার সত্যের? এবং কেন? রবীন্দ্র-বিবেকানন্দের দেশে গণতন্ত্র মৃত।"

 

 

ফিল্ম কী নিয়ে? ১৯৪৬-এর কলকাতা দাঙ্গা এবং গোপাল মুখোপাধ্যায়ের লড়াই

"দ্য বেঙ্গল ফাইলস" অবিভক্ত বাংলার ১৯৪০-এর দশকের ধর্মীয় সহিংসতা নিয়ে তৈরি একটি ডকু-ড্রামা ফিল্ম। বিশেষ করে ১৯৪৬ সালের ‘ডায়রেক্ট অ্যাকশন ডে’-এর ঘটনা, যখন কলকাতায় হিন্দু-মুসলিম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে এবং হাজারো মানুষ নিহত হন।

 

ফিল্মটি কেবল সহিংসতা দেখায় না — দেখায় গোপাল মুখোপাধ্যায়ের মতো ব্যক্তিত্বদের প্রতিরোধের গল্প, যারা সেই অন্ধকার সময়ে নিজেদের প্রাণ দিয়ে মানুষকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছিলেন।

 

অগ্নিহোত্রী বলেন,

"এটা ইতিহাস। ইতিহাস বদলানো যায় না। কিন্তু কেন তবে এই সত্য দেখাতে ভয় পাওয়া হচ্ছে? এর পিছনে শুধু একটাই কারণ হতে পারে — বাংলাকে আবার ভাগ করার ষড়যন্ত্র।"

 

 

TMC-এর প্রতিক্রিয়া: "গুজরাট দাঙ্গা নিয়ে কেন ফিল্ম না?"

ঘটনার পর তৃণমূল কংগ্রেসের বরিষ্ঠ নেতা এবং রাজ্যের শিক্ষা মন্ত্রী ব্রত্য বসু প্রতিক্রিয়া দিয়ে বলেন,

"অগ্নিহোত্রী ২০০২ সালের গুজরাট দাঙ্গার উপর ফিল্ম কেন বানাচ্ছেন না? তিনি কি আসলে RSS-বিজেপির জন্য কাজ করছেন?"

 

তিনি আরও বলেন,

"পুলিশ এবং হোটেল কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত ছিল সম্পূর্ণ প্রশাসনিক। কোনো রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ নেই।"

 

কিন্তু এই ব্যাখ্যা মানতে রাজি নন বিজেপি নেতারা।

 

 

বিজেপির প্রতিক্রিয়া: গণতন্ত্র মৃত?

বিজেপির রাজ্য নেতা শংকুদেব পাণ্ডা বলেন,

"একটি ফিল্মের ট্রেলার দেখানোর জন্য পুলিশের হানা — এটা কি গণতান্ত্রিক সমাজে চিন্তা করা যায়? সেন্সর বোর্ড পাশ করেছে, আদালত নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছে, তবু কেন দেখানো যাবে না? এটা প্রমাণ করে বাংলায় গণতন্ত্র মৃত।"

 

সিসির বজরিয়াও বলেন,

"আমরা জনগণকে নির্বাচন করতে দিই। তারা কী দেখতে চায়, তা তাদের সিদ্ধান্ত। সরকার কেন তাদের চোখে আঙুল দিচ্ছে?"

 

 

বিকল্প প্রদর্শন: বিজেপি অফিসে ট্রেলার চালু

যে ট্রেলার হোটেলে দেখানো যায়নি, তা পরে কলকাতার সল্ট লেকে বিজেপির রাজ্য কার্যালয়ে প্রদর্শিত হয়। পার্টি কর্মী, মিডিয়া এবং সমর্থকদের উপস্থিতিতে ট্রেলারটি চালানো হয়। এটি ছিল এক প্রতীকী বিজয় — সত্য যে কোনো বাধায় থামে না।

 

 

প্রযোজকের হুঁশিয়ারি: "৫ সেপ্টেম্বরে মুক্তি হবেই ফিল্ম"

প্রযোজক অভিষেক আগরওয়াল পিটিআইকে বলেন,

"কোনো শক্তিই আমাদের ৫ সেপ্টেম্বর মুক্তির পথে থামাতে পারবে না। আমরা আইনি পরামর্শ নিচ্ছি। আজকের ঘটনার পর আমরা দ্রুত আদালতে যাব।"

 

 

কী শেখা গেল?

  1. সত্য ভয় পায় না — কিন্তু ক্ষমতা পায়।
    যখন কোনো ফিল্ম ইতিহাসের সত্য তুলে ধরে, তখন তা কেবল মনোরঞ্জন নয় — এটি একটি রাজনৈতিক বার্তা।

  2. মুক্ত অভিব্যক্তির অধিকার ঝুঁকির মুখে।
    যদি একটি হোটেলে ট্রেলার দেখানো যায় না, তবে কি বাংলায় স্বাধীন চিন্তা আর নিরাপদ?

  3. রাজনীতি আর সংস্কৃতির সংঘাত তীব্রতর।
    ফিল্ম আর ইতিহাস এখন রাজনৈতিক হাতিয়ারে পরিণত হচ্ছে।

 

 

সারাংশ: একটি ট্রেলার নয়, একটি যুগান্তকারী মুহূর্ত

"দ্য বেঙ্গল ফাইলস"-এর ট্রেলার আটকানো শুধু একটি ঘটনা নয় — এটি একটি প্রতীক। এটি দেখায় যে কীভাবে ইতিহাস, সত্য এবং গণতন্ত্র কখনও কখনও রাজনীতির খেলার মাঠে পরিণত হয়। কিন্তু আজ প্রমাণিত হল — সত্য যে কোনো বাধায় থামে না।

 

৫ সেপ্টেম্বর মুক্তি পাক ফিল্ম। আর তার আগেই এটি হয়ে উঠল দেশজুড়ে আলোচনার বিষয়।

 

 

আপনার মতামত জানান

আপনি কি মনে করেন ইতিহাস নিয়ে ফিল্ম বানানো উচিত? কেন ট্রেলার আটকানো হল? কমেন্টে লিখুন। আমাদের সাথে যুক্ত থাকুন — আমরা প্রতিদিন এমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা করি।